English | Bangla
জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক কোম্পানীর প্রভাব প্রতিহত করতে হবে
বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নের ১৫ বছর অতিবাহিত হলেও নীতিতে তামাক কোম্পানিগুলোর অযাচিত  হস্তক্ষেপের কারণে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এখনও  কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রাঅর্জনে সফল হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করলেও বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার অঙ্গীকারের সঙ্গে তামাক কোম্পানিতে সরকারের অংশীদারিত্বের বিষয়টি পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। কেননা তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার থাকার সুযোগ গ্রহণ করে তামাক কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন যাবত নানাভাবে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সহায়ক নীতি প্রণয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে। জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন, মানুষের জীবনে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব, তামাক কো¤পানির আগ্রাসী কার্যক্রম বন্ধে ও তামাক নিয়ন্ত্রণে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অনতিবিলম্বে তামাক কো¤পানির হস্তক্ষেপ বন্ধ করা জরুরী। প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে হলে তামাক কোম্পানিতে বর্তমানে সরকারের যে অংশীদারিত্ব রয়েছে তা প্রত্যাহারের পাশাপাশি এখন থেকেই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এমতাবস্থায় সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ ও সার্বিক তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীকে অধিক জোরদার করা জরুরী।
 
উক্ত বিষয়াবলী বিবেচনায় নিয়ে আজ ১৩ এপ্রিল, ২০২২ ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট ও বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট’র সম্মিলিত উদ্যোগে অনলাইন প্লাটফর্মে আয়োজিত স্ট্র্যাটেজিক মিটিং এ বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন। ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট এর বিভাগীয় প্রধান (স্বাস্থ্য অধিকার বিভাগ) সৈয়দা অনন্যা রহমানের সঞ্চালনায় সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট’র প্রকল্প কর্মকর্তা সামিউল হাসান সজীব। এছাড়া বক্তব্য রাখেন, এইড ফাউন্ডেশনের প্রকল্প পরিচালক শাগুফতা সুলতানা, ব্যুরো অফ রিসার্চ ইব্রাহীম খলিল,  থ্রী স্টার এ-র নির্বাহী পরিচালক ইলিয়াছ হোসেন, এসডিএস এ-র নির্বাহী পরিচালক জুবায়ের  আহমদ ,ডাস-বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আমিরুল ইসলাম লিন্টু, প্রজন্ম মানবিক অধিকার কেন্দ্রের সভাপতি আব্দুর রহমান রিজভী, সোস্যাল এ্যাডভান্সমেন্ট ফোরাম (সাফ)’র  নির্বাহী পরিচালক মীর আব্দুর রাজ্জাক, ডেভেলপমেন্ট ফর ডিজএ্যাডভান্টেজ পিপল (ডিডিপি)’র নির্বাহী পরিচালক কাজী সোহেল রানা, সিয়ামের জেনারেল সেক্রেটারী এ্যাডভোকেট মোঃ মাসুম বিল্লাহ  সহ আরো অনেকে।
 
সৈয়দা অনন্যা রহমান বলেন, জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে তামাকের ব্যবহার হ্রাস করা সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। কিন্তু তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের নানাধরণের ইতিবাচক পদক্ষেপ গৃহীত হওয়া সত্বেও বর্তমান সময়ে কোম্পানিগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করে সর্বাধিক বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে বিক্রয় কেন্দ্রে তামাক কোম্পানির ব্র্যান্ডিং রং ও লোগো সম্বলিত শোকেস, খালি প্যাকেট, ষ্টিকার, পোস্টার, ফ্লাইয়ার লাগানো, রেস্টুরেন্টে ‘স্মোকিং জোন’ তৈরী, নাটক-সিনেমায় অহরহ ধূমপানের দৃশ্য প্রচার, জনপ্রিয় ব্যক্তিদের মাধ্যমে প্রচারণা, বিক্রয়কর্মী ও ক্রেতাদেরকে বিভিন্ন উপহার প্রদান ইত্যাদি অন্যতম। ধোঁয়াবিহীন তামাক কোম্পানিগুলোও প্রচারণার ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। তামাক কোম্পানিগুলো অধিক মুনাফা অর্জন, ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং বিভিন্ন ধরনের সুবিধা আদায়ের জন্য নানা কৌশলে আইন লঙ্ঘন ও হস্তক্ষেপ করছে। কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী আচরণ আইন বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরী করছে।
 
কাজী এনায়েত হোসেন বলেন, জেটিআই’র বর্তমান কার্যক্রমকে বন্ধ করতে জাপান রাষ্ট্রদূতকে বাংলা, ইংরেজী ও জাপানি ভাষায় স্মারকলিপি দেয়ার পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংবাদগুলো নিয়ে ভিডিও বানাতে পারি। টাস্কফোর্সের কমিটিতে এ ভিডিও প্রদশর্ন করতে পারি। জাতীয়  রাজস্ব বোর্ড সম্মুখে তামাক কোম্পানির বিরুদ্ধে অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে পারি। তামাক চাষ হচ্ছে এমন জায়গায় তামাক বিরোধী ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা। আরও বেশি লেটার ক্যাম্পেইন, স্মারক লিপি প্রদান, প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণ  আন্দোলকে অবশ্যই আমরা সফল করতে পারব ।
 
কাজী সোহেল রানা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে হলে এখন থেকেই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন, যাতে তামাক কোম্পানিতে বর্তমানে সরকারের যে অংশীদারিত্ব রয়েছে তা প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। তামাক  কোম্পানির সঙ্গে অপ্রয়োজনীয়  যোগাযোগ, স্বচ্ছতা সংক্রান্ত, সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ, নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তামাক কোম্পানির অংশগ্রহণ, তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কার্যক্রম নিষিদ্ধে গুরুত্ব দিতে হবে। তামাক কোম্পানিকে পুরস্কৃত করার কোনো অনুষ্ঠানে সরকারি প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা, এসব কোম্পানিকে দেওয়া সব সুবিধা প্রত্যাহার, নতুন কোনো বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ করাসহ বেশ কিছু সুপারিশ করা হয় তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোকে তামাক নিয়ন্ত্রণে জবাবদিহির জায়গা নিশ্চিত করতে হবে। আর এসব কাজের জন্য অবশ্যই সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয় থাকতে হবে।
 
শাগুফতা সুলতানা বলেন, তামাক বিক্রয়  নিয়ন্ত্রণ  করতে হলে তামাককে লাইসেন্সিং এর আওতায় এনে নিয়ন্ত্রণ করা যায় ।  স্থানীয় সরকার একটি গাইডলাইন বের করেছে সেখানে উল্লেখ আছে  লাইসেন্সিং সিস্টেমের মাধ্যমে আমরা কোন দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারি । স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়,  সিটি কর্পোরেশন, মিউনিসিপ্যালটি  এ লাইসেন্স  প্রদান করবে ।  তামাক বিক্রয়কে লাইসেন্সিং ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা জোনিং এর আওতায় নিয়ে আসতে পারি । এসডিজি রাস্তবায়নের দিকে আমরা যদি এগিয়ে যেতে চাই তাহলে অবশ্যই তামাক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে । ইউরোপ , আমেরিকা, ইন্ডিয়া এমনকি নেপালেও লাইসেন্সিং ব্যবস্থা প্রচলন রয়েছে । তরুণদের আকৃষ্ট করতে যে সকল স্থানে তরুণদের সমাগম বেশি সেখানে তামাক বিক্রয়কেন্দ্র গড়ে উঠে। লাইসেন্সিং ব্যবস্থার মাধ্যমে স্কুল কলেজের আশেপাশে যেন তামাক বিক্রয়কেন্দ্র গড়ে না উঠে লাইসেন্সিং ব্যবস্থার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। স্থানীয় সরকার  মন্ত্রণালয় লাইসেন্সিং ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে অত্যন্ত প্রশংসা অর্জন করেছে । ২০৪০ সালের মধ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা সহায়ক ভূমিকা পালন করবে । 
 
সামিউল হাসান সজীব বলেন, তামাক  কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম  বন্ধ  করতে এফসিটিসির আলোকে বর্তমান ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার ( নিয়ন্ত্রণ)  আইন, ২০০৫ সংশোধন  করে তামাক  কোম্পানির কর্পোরেট  সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সিএসআর কার্যক্রম সম্পূর্ণ  নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, রাজশাহীতে  তামাক কোম্পানি নিরাপদ পানির প্ল্যান্ট প্রবাহ স্থাপন করে। সুন্দরবনে পানি পরিশোধনের প্রকল্প উদ্বোধন, জিকে প্রকল্প ঘিরে গড়ে উঠেছে তামাক কোম্পানির সামাজিক  বনায়ন কার্যক্রম। ভোলায় ব্রিটিশ আমেরিকান  টোব্যাকোর ডিস্ট্রিবিউটর এ রহমান এন্ড  সেন্সর উদ্যোগে  গড়ে উঠেছে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন রেজিষ্ট্রেশনবুথ। তামাক নিয়ন্ত্রণে নির্দিষ্ট দপ্তরে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দ্রুত বদলি আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদে সরকারের উচ্চপদস্থ কয়েকজন রয়েছেন। তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার থাকার সুযোগ গ্রহণ করে তামাক কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন যাবত নানাভাবে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সহায়ক নীতি প্রণয়নে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করছে। তামাক কোম্পানির নিজস্ব তথ্যাদি বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণায় দেখা যায় বিগত দিনে কোম্পানিগুলো সরকারকে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদানের মাধ্যমে আইন প্রণযন,আইন সংশোধন, তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি, তামাতজাত দ্রব্যের মোড়কে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী  প্রদান এমনকি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নেও কূটকৌশল অবরম্বন করছে । এফসিটিসি অনুসারে বিশে^র বিভিন্ন দেশ তামাক কোম্পানির প্রভাব থেকে নীতি সুরক্ষায় দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সেগুলো আমরা অনুসরণ করতে পারি। ব্রিটিশ-আমেরিকান ট্যোবাকো কোম্পানি থেকে সরকারের শেয়ার প্রত্যাহারে দাবীকে আরও  জোড়ালো করতে হবে ।