English | Bangla
দূষণ ও দখলের কবলে রাজধানীর লেক

মতিন আব্দুল্লাহ : দখল ও দূষণে বিপন্ন রাজধানীর লেকগুলো। নানামুখী দখল ও ভরাটে লেকগুলোর অস্তিত্ব চরম সঙ্কটে পড়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো লেকের উন্নয়নের নামে চোর-পুলিশ খেলা খেলছে। একদিকে উচ্ছেদ ও আবর্জনা পরিষ্কার করছেন, অন্যদিকে আবারও দখল ও ভরাট হয়ে যাচ্ছে লেকগুলো। কোনোভাবেই দখল-দূষণের বৃত্ত থেকে লেকগুলোকে মুক্ত করতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি রাজধানীর ধানমণ্ডি, গুলশান ও উত্তরা লেক সরেজমিন ঘুরে দখল-দূষণের করুণ চিত্র দেখা গেছে।

ধানমণ্ডি লেক: ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হচ্ছে ধানমণ্ডি লেক। লেকপাড়ের বাসিন্দাদের সুয়ারেজ লাইনের সংযোগ লেকের পানিকে বিষাক্ত করে তুলছে। প্রতিদিন লেকের দূষণ ও দখলের কবলে রাজধানীর লেক বিভিন্ন অংশে প্রচুর আবর্জনা পড়ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) সূত্রে জানা গেছে, লেকপাড়ের বাসিন্দা এবং ভ্রমণার্থীরা লেকের পানিতে আবর্জনা ফেলছেন। ডিএসসিসি অভিযোগ, অনেক চেষ্টা করেও এলাকাবাসী বা ভ্রমণার্থীদের সচেতন করা যাচ্ছে না।

সম্প্রতি সরেজমিন ধানমণ্ডি লেক এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মিরপুর রোড সংলগ্ন স্লুইসগেট অংশের লেকে দেদার ফেলা হচ্ছে আবর্জনা। আশপাশের এলাকার ফুটপাথের ব্যবসায়ী, দোকানদার পথচারী ও বাড়ির মালিকরাও তাদের কাজের লোক দিয়ে লেকের পানিতে এসব আবর্জনা ফেলছেন। লেকে ঘুরতে আসা তরুণ-তরুণী ও রিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষরা ফুচকা, চিপস বা অন্য যে কোনো খাবার খেয়ে নির্বিচারে লেকে উচ্ছিষ্ট ফেলছেন।

লেকপাড়ের দোকানদার রহমত আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন একদিন আবর্জনা পরিষ্কার করলে সাত দিন করে না। তিনি বলেন, ৩২ নম্বর এলাকায় যেদিন প্রধানমন্ত্রী আসেন সেদিন পরিষ্কার হয়। এরপর আর সিটি করপোরেশনের লোকদের দেখা মেলে না। অন্য এলাকায় তাদের পরিছন্নতা কার্যক্রম তেমন একটা চোখে পড়ে না।

অভিজাত আবাসিক এলাকা ধানমণ্ডির প্রাণ বলা হয়ে থাকে ধানমণ্ডি লেককে। এ লেকে সকাল-বিকাল ওই এলাকা এবং আশপাশের বাসিন্দারা হাঁটাহাঁটি, প্রাতঃভ্রমণ এবং ব্যায়াম করেন। ঘোরাঘুরি করেন ছেলেমেয়ে বা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। গাছপালা বেষ্টিত ছায়া ঢাকা পরিবেশ লেক এলাকার। এক সময় লেকটি দৃষ্টিনন্দন ছিল। দিনে দিনে লেকের পরিবেশ নোংরা, দূষিত হচ্ছে। লেকের আধুনিকায়ন খাতে ডিএসসিসির বিশেষ তহবিল বরাদ্দ রাখা হলেও তেমন সুফল আসছে না।

জানতে চাইলে ডিএসসিসির অঞ্চল-২-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী খায়রুল বাকের দৈনিক বর্তমানকে বলেন, ধানমণ্ডি লেকের আবর্জনা পরিষ্কারের কাজ বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে। ডিএসসিসি শুধু তাদের কার্যক্রম মনিটরিং করেন। তিনি বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও আমরা একত্রে চেষ্টা করেও ধানমণ্ডি লেকের আবর্জনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না। তিনি বলেন, লেকপাড়ের বাসিন্দাদের বেশি উপকারে আসছে লেকটি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, লেক ভরাটের ক্ষেত্রে তারাই বেশি ভূমিকা রাখছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন।

ধানমণ্ডি লেকের আবর্জনা পরিষ্কারে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থা ‘ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট’। জানতে চাইলে ডাব্লিউবিবি ট্রাস্টের অ্যাডভোকেসি অফিসার সৈয়দ সাইফুল আলম বলেন, লেকের সাতমসজিদ থেকে মিরপুর রোড পর্যন্ত লেক অংশের পানিতে প্লাস্টিক, পলিথিনসহ বিভিন্ন অপচনশীল আবর্জনা রয়েছে। এসব ডিএসসিসি বা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কেউই পরিষ্কার করছে না। জনসচেতনতা বাড়াতে মাঝেমধ্যে আমরা লেকের আবর্জনা পরিষ্কার করি।

গুলশান লেক: গুলশান লেকের দখল-দূষণ থামছে না। নানামুখী দখল-দূষণে বিপন্ন হতে চলেছে লেকটি। সম্প্রতি গুলশান এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, লেকপাড়ের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিনই টনে টনে ময়লা-আবর্জনা পড়ছে। অন্যদিকে রয়েছে দখল প্রতিযোগিতা। বাঁশের খুঁটি গেঁড়ে, ঘর বানিয়ে দুর্বৃত্তরা লেকের বিভিন্ন স্থান দখল করছে। মাঝেমধ্যে উদ্ধার কাজ চললেও বন্ধ হচ্ছে না দখল ও দূষণের তাণ্ডব। উচ্চ আদালত থেকে লেক দখল ও দূষণমুক্ত রাখতে একাধিকবার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক করলেও আদালতের নির্দেশনা কার্যকর হচ্ছে না।

গুলশান লেক স্থায়ীভাবে দখলমুক্ত করতে লেকের দু’পাড়ে ওয়ার্কওয়ে করার উদ্যোগ নিয়েছিল রাজউক। যে কাজ এখনও শুরু হয়নি। নগর বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীদের পরামর্শ ওয়ার্কওয়ে করে কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করলে অভিজাত আবাসিক এলাকা গুলশানের প্রাণ ‘গুলশান লেক’ বেঁচে যাবে। অপরদিকে লেককে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে রাজউক, ওয়াসা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা জেলা প্রশাসন। তবে গুলশানবাসী শঙ্কিত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকল্প নিয়ে। আদৌ কোনো কাজ হবে, না অর্থের অপচয় হবে, তা নিয়ে অভিজাত এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে এখনও সংশয় রয়েছে। প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও এখনও কোনো সুফল বয়ে আসেনি।

সম্প্রতি মহাখালী গাইসুল আজম মসজিদ সংলগ্ন এলাকা থেকে বনানী ব্রিজ পর্যন্ত অংশ নৌকাযোগে সরেজমিন ঘুরে দেখা হয়েছে। গুলশান লেকের কড়াইল বউবাজার অংশের দখলদাররা বেপরোয়া হয়ে দখলযজ্ঞ চালাচ্ছেন। দখলদাররা লেকের নতুন জায়গাসহ উচ্ছেদকৃত অংশে বাঁশের খুঁটি গেড়ে টিনের ছাউনি দিয়ে দুই শতাধিক ঘর তুলেছে। কড়াইল গুদারা ঘাটে টঙঘরের সংখ্যা দেড় শতাধিক। পাকা ঘাটের লেক পাড়ে রয়েছে অর্ধশতাধিক টঙঘর। এ ছাড়াও চামেলীর মার ঘাট ও মোমিনের ঘাটে শতাধিক টঙঘর গড়ে উঠেছে। করাইল ঘাট, গুলশান ৩৩, ৩৪ ও ৩৫ নম্বর রোডের মাথায় রাজউকের উচ্ছেদ করা অংশে নতুন করে কোনো ঘর গড়ে না উঠলেও প্রস্তুতিমূলক তত্পরতা দেখা গেছে।

টিঅ্যান্ডটি কলোনি ঘাটে সরাসরি আর্বজনা ফেলা হচ্ছে। লেকের বিশাল অংশ এসব ময়লা-আর্বজনায় ইতোমধ্যে ভরাট হয়ে গেছে। মহাখালী গাউসুল আজম মসজিদসংলগ্ন লেকের অংশ থেকে বনানী ব্রিজ পর্যন্ত সরেজমিন চোখে পড়েছে লেকের দখল-দূষণের নানা চিত্র।

কড়াইল বস্তিতে লেকের ভেতর দিয়ে গ্যাস, পানির চোরাই লাইন টানা হয়েছে। ওপর দিয়ে এলোমেলো ভাবে চোরাই বিদ্যুত্ ও ডিশের লাইনের সংযোগও নেয়া হয়েছে। লেকের পানিতে কাপড়ের টুকরা, মুরগির পাখনা, কুকুর, বিড়ালের মৃতদেহ ভাসতে দেখা গেছে। লেকের করাইল বস্তি সংলগ্ন লেকের পাড় ঘেঁষে অর্ধশতাধিক খোলা ল্যাট্রিন করা হয়েছে। যার সরাসরি সংযোগ দেয়া হয়েছে লেকে।

জানতে চাইলে গুলশান সোসাইটির সভাপতির সাবেক সভাপতি সি এম শফি সামী গতকাল দৈনিক বর্তমানকে বলেন, আমি সভাপতি থাকা অবস্থায় উচ্চ আদালতে লেক রক্ষার ব্যাপারে রিট করা হয়েছিল। আদালত তখন লেক রক্ষার ব্যাপারে কোনো সংস্থার কী করণীয় তা পরিষ্কার করে বলেছেন। রাজউককে লেক দখলমুক্ত করতে আদালত নির্দেশনা দিলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি।

গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়নে ওই এলাকাবাসী দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলন করে আসছে। এলাকাবাসীর আন্দোলনের মুখে সরকার ২০১১ সালে গুলশান লেকের আধুনিকায়নে বিশদ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। প্রকল্পটি ওই বছর একনেকে অনুমোদন পায়। ৪১০ কোটি ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয় লেকের উন্নয়নে।

এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে, অবৈধ দখলদার এবং লেকটিকে দূষণের কবল থেকে রক্ষা করা। লেকের চারদিকে হাঁটার পথ তৈরি এবং লেকের পরিবেশকে দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা। আড়াই বছর পার হলেও এখনও কার্যকর কোনো কিছুই করতে পারেনি রাজউক। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ৮১ একর জমি অধিগ্রহণ করার প্রয়োজন হলেও এখনও কোনো জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি। নতুন করে গুলশান লেকে কোনো হাঁটার পথও তৈরি হয়নি।

জানতে চাইলে রাজউকের সদস্য (অর্থ) মাহবুব উল আলম দৈনিক বর্তমানকে জানান, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত প্রাথমিক নকশা ও প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে সংশোধিত ডিপিপি প্রস্তুত করা হয়েছে। তাছাড়া বাস্তব অবস্থার আলোকে কিছু কিছু অংশে নতুনভাবে জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে। এ বিষয়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, রাজউকের নগর পরিকল্পনা শাখা, প্রকল্প দফতর ও ভূমি শাখা যৌথভাবে কাজ করছে।

উত্তরা লেক: আর্বজনা, শিল্প কারখানার দূষণে শ্রীহীন দশা উত্তরা লেকের। লেকের বেড়িবাঁধ অংশে সরেজমিন দেখা গেছে, এখানেও চলছে দখল। হাসপাতাল ও শিল্পবর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে লেকে। উত্তরা অ্যাসোসিয়েশন লেকটি বাঁচাতে নানামুখী আন্দোলন, কর্মসূচি চালালেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

বর্তমানে উত্তরা লেকের আধুনিকায়নের কাজ একটি বেসকারি প্রতিষ্ঠানকে লিজ দেয়া হয়েছে। তারা সেখানে মাছচাষ করছে। দখল-দূষণ নিয়ন্ত্রণে এ প্রতিষ্ঠানটির কোনো ভূমিকা নেই বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

দেখা গেছে, বেড়িবাঁধ সংলগ্ন (উত্তরা লেক মসজিদ) লেকের পাড় থেকে দাঁড়িয়ে লেকের দিকে তাকালে দেখা যাবে লেকের দু’পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে বাড়িঘর ও বড় বড় স্থাপনা। বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা, শিল্প কলকারখানার বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে লেকে। বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকায় লেকের পাড় দখল করে বেশ কয়েকটি বড় বড় স্থাপনাও গড়ে উঠেছে। এসব স্থাপনা ওই এলাকার প্রভাবশালীদের। যাদের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতাও রয়েছে।

জানতে চাইলে ৫ নাম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারি এম এ ওয়াদুদ বলেন, রাজউক উত্তরা লেকের তেমন কোন উন্নয়ন করতে পারেনি। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকে লিজ দেয়া হয়েছে। তারা লেকের মাঝখানে পাকা ইটের একটি স্থাপনাও গড়ে তুলেছেন। যা সম্পূর্ণ বেআইনি ।

রাজউকের লেক উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক এ এস এম রায়হানুল ফেরদৌস দৈনিক বর্তমানকে জানান, লেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। পর্যায়ক্রমে লেকগুলোর আধুনিকায়ন ঘটবে। তিনি দাবি করেন, গুলশান ও উত্তরা লেকের পরিবেশ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে।

http://dailybartoman.com/print.php?nc=1&news_id=1372