English | Bangla
“সমন্বিত যাতায়াত ব্যবস্থার অভাব, যানজট ও ঝুঁকিপূর্ণ যাতায়াত” শীর্ষক আলোচনা সভা
সাধারণ মানুষের যাতায়াত সুবিধা বিবেচনা না করে বিলাসী প্রকল্পে গুরুত্ব দেয়া ও সমন্বিত যাতায়াত ব্যবস্থার অভাবে পরিবহন ব্যবস্থা যাত্রীদের জন্য যন্ত্রণাময় আর ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নৌ, রেল, বাসসহ গণ-পরিবহনে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির কারণে মানুষ বাধ্য হয়ে শহরের অভ্যন্তরীণ যাতায়াতে প্রাইভেটকার ও দুরপাল্লার যাতায়াতে বাসের দিকে ঝুঁকছে। ফলে রাস্তায় অসহনীয় যানজটে ঘন্টার পর ঘন্টা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ঈদের সময় যাতায়াত বিডম্বনা আরও  প্রকট আকার ধারণ করে। অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় দুর্ঘটনা, দূষণ, যানজট যন্ত্রণা। যাতায়াত ব্যবস্থার এ নৈরাজ্য দুর করতে রেলকেন্দ্রিক নৌ ও সড়ক পথের সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ১২ জুলাই ২০১৪, সকাল ১১ টায় পবা কার্যালয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও ডাব্লিউবিবি ট্রাস্টের যৌথ উদ্যোগে “সমন্বিত যাতায়াত ব্যবস্থার অভাব, যানজট ও ঝুঁকিপূর্ণ যাতায়াত” শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। 
 
সভায় বক্তারা বলেন, পরিবেশগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, স¦াস্থ্য, মানব সম্পদ উন্নয়ন তথা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। অতিরিক্তি সড়ক নির্ভরতা দূর্ঘটনা, দূষণ, জ্বালানি ব্যয়, যাতায়াত খরচ, যানজট ও যানজটজনিত সময়ের অপচয়সহ নানারকম সমস্যা বেড়ে চলেছে। দেশের একমূখী যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সড়কের উপর পড়ছে সীমাহীন চাপ, ফলে দূর্ঘটনার পরিমানও দিন দিন বাড়ছে। রা¯তাও দ্রুত নষ্ট হচ্ছে এবং তার মেরামত ও পরিচালনা ব্যয় দেশের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করছে। সড়ককেন্দ্রিকতা ফসলি জমি সংকোচনের জন্যও দায়ী। সড়ক নির্ভরতা বৃদ্ধিজনিত কারণে ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনার কারণে উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু কিংবা পঙ্গুত্বের জন্য পারিবারিক পর্যায়ে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। সড়ক নির্ভরতার কারণে বায়ু দূষণ, শব্দদূষণসহ নানারকম পরিবেশ দূষণ বাড়ছে। এসব দূষণের কারণে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, স্ট্রোক, বধিরতাসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়ছে। জ্বালানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে, কারণ অধিকাংশ জ্বালানি দেশের বাহিরে থেকে আমদানী করতে হয়। সড়কনির্ভর যাতায়াত ব্যবস্থায় ক্রমান্বয়ে যানবাহন বেড়েছে, যেজন্য বৃদ্ধি পেয়েছে যানজট ও যাতায়াত ব্যয়। 
 
প্রতিবছর রমজান মাসে ঢাকা শহরে যাতায়াতের ক্ষেত্রে যানজট ও যানবাহন সঙ্কটে নগরবাসীকে নাকাল হতে হয়। এই মাস শেষে মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বড় উৎসব ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষ্যে ঢাকা শহর থেকে প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষ ঢাকা ছেড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যান এবং পুনরায় ফিরে আসেন। এই উপলক্ষকে কেন্দ্র করে মাত্র কয়েকটি দিন উপভোগ করতে যাওয়া মানুষের সকল আনন্দ নিরানন্দে পরিণত হয় যাতায়াতের ক্ষেত্রে তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে। তাই রমজান মাসে ঢাকা শহরসহ দেশের সর্বত্র যাতায়াত নিরাপদ ও স্বচ্ছন্দময় করার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। যদিও প্রতি বছর সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পরিবহন সেবা প্রদানকারীগণ এ বিষয়ে নানা পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকেন। তারপরও পূর্বের বছরগুলিতে নানা হয়রানি পরিলক্ষিত হয়েছে। যা সমাধানে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। 
 
সড়ক পথ সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে এর পরিচালনা ও মেরামতের সঠিক পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ না থাকা, বিদ্যমান আইন প্রয়োগে শিথিলতা, আইন সংস্কারের মাধ্যমে যুগপোযোগী না করা, নির্বিচারে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান, ত্রুটিযুক্ত যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ না করা, ত্রুটিপূর্ণ সড়ক নির্মাণ, দূর্ঘটনার জন্য দায়ীদের শাস্তি না হওয়া, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত চালক তৈরির জন্য পর্যাপ্ত ইন্সটিটিউশনাল সুবিধা না থাকা, সড়কে দক্ষ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা না থাকা, সড়কে প্রয়োজনীয় সংকেত ও নির্দেশনা সম্বলিত সাইন না থাকা, দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানোÑ ইত্যাদি নানা কারণে সড়ক দূর্ঘটনা ক্রমশ বেড়ে চলছে। 
 
প্রকৌশলী  মো: আবদুস সোবহান বলেন, যাতায়াত ব্যবস্থায় সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে দূরদর্শীতার সঙ্গে বিদ্যমান সড়ক নেটওয়ার্কের মধ্যে নিরাপদ যাতায়াতের জন্য একটি সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সড়ক নির্ভরতা কমিয়ে রেল ও নৌ ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এই দুইটি মাধ্যমের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, লোকবল ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি বৃদ্ধি, যান্ত্রিক ও কারিগরি দক্ষতা বাড়ানো, পর্যাপ্ত যানের ব্যবস্থা করা এবং প্রশিক্ষণ এর পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। এছাড়া নিরাপদে পথচারী ও অযান্ত্রিক যান চলাচলের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার।
 
আমাদের সুপারিশ
ক্স রেল ও নৌ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণ করা এবং সড়ক নির্ভরতা কমানো; 
ক্স রেল লাইন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা, রেলওয়ের লোকবল বৃদ্ধি করা, রেলওয়ের লোকোমটিভ, যাত্রী কোচ ও মালবাহী ওয়াগন বৃদ্ধি করা; রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিকায়নে এবং রেলের দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নে কারখানাগুলোকে কার্যকর করা; 
ক্স ঢাকা-চট্রগ্রাম রেল লাইন চারলেন করা। দুই লাইন যাত্রা পরিবহন ও বাকি দুই লাইন মালামাল পরিবহনে ব্যবহার করা। এর পাশাপাশি ঢাকা চারিপাশের জেলাসমূহের মধ্যে নূন্যতম পক্ষে দুই লাইনের রেল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা।
ক্স নৌপথ উন্নয়নে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা, নদীপথের নাব্যতা ঠিক রাখা, নদী দখল-দূষণমুক্ত রাখা, নৌ যানের ফিটনেস নিয়মিত চেক করা; 
ক্স বিদ্যমান সড়ক পথ পরিচালনা, যথাযথভাবে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা, ভূয়া লাইসেন্সধারী চালকদের নিষিদ্ধ ও শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা, অপরাধকারী চালকদের শাস্তির মেযাদ বৃদ্ধি করা, আনফিট গাড়ি বাতিল করা, যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ করা, বিআরটিএ’ কে স্বচ্ছ ও কার্যকর করা; 
ক্স শহর এলাকায় পথচারী ও সাইকেল নিরাপদে চলাচলের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা, নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ী পাকিং করা। 
 
ঈদে নিরাপদ ও স্বচ্ছন্দে ঢাকা থেকে বাড়ী যাওয়া-আসার জন্য করণীয় 
ক্স সরকারি, আধা সরকারী  ও স্বায়ত¦শাসিত সংস্থায় কর্মরতদের ভাগ করে আগে পরে ছুটি প্রদান করা। অর্থাৎ যারা ঈদের একটু বেশি আগে যাবে তারা তাড়াতাড়ি ফিরবে। আর যারা ঈদের একদিন অথবা দুইদিন আগে যাবে তারা একটু দেরিতে ফিরবে।
ক্স রেলগাড়ি, বাস ও নৌযানের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। 
ক্স গার্মেন্টসসহ শ্রমিক সমৃদ্ধ শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের ভাগ করে আগে পরে ছুটি প্রদান করা। 
ক্স হাইওয়েতে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও আনসার বাহিনীকে নিয়োগ করা। বেপরোয়া চালনা ও গতি নিয়ন্ত্রণে বাস চালক ও মালিকদের সর্তক করা। সব ধরনের যানবাহন বিশেষ করে মোটরযান ও নৌযনের ফিটনেস সঠিকভাবে পরীক্ষা করা। 
ক্স সড়ক ও রেলপথ প্রয়োজনীয় স্থানে সংস্কার করা।
 
ঢাকা শহরে স্বাভাবিক যাতায়াত নিশ্চিত করতে করণীয় 
ক্স ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, বিআরটিএ, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কর্তৃক সমন্বিতভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করা, 
ক্স বিআরটিসিসহ বেসরকারি বাস সার্ভিস কর্তৃক সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করা,  
ক্স বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ স্বায়ত্বশাসিত সংস্থাসমূহে ব্যবহৃত বাসগুলি নিয়মিত সার্ভিসের আওতায় নিয়ে আসা, গাজীপুর-কমলাপুর-নারায়নগঞ্জ কমিউটার ট্রেনে চাহিদানুযায়ী বগি সংযোজন করা, 
ক্স সড়ক ও ফুটপাতে গাড়ি পার্কিং সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ করা, 
ক্স একদিন জোড় ও অন্যদিন বেজোড় সংখ্যার লাইসেন্স নাম্বার অনুসারে প্রাইভেট গাড়ি চলাচলের নিয়ম করা, 
ক্স শুধুমাত্র নির্ধারিত স্থানে গাড়ী পার্কিং করা, 
ক্স ফুটপাতে হকারদের জিনিসপত্র খাড়াভাবে সাজানোর মাধ্যমে সুশৃঙ্খলভাবে ব্যবসা করার জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।
ক্স ফুটপাতে মোটর সাইকেল চলাচল প্রতিরোধ করা, 
ক্স ট্যাক্সি ক্যাব ও সিএনজি থ্রি হুইলার এর উপর নজরদারি বৃদ্ধি করা, 
ক্স ইন্টারসেকশন হতে ৫০ মিটার দূরে বাসে যাত্রী উঠানো নামানোর ব্যবস্থা করা।